রোদটা আজকে বেশ কড়মড়ে। চৈতালী সুর্যটা যেন একটু বেশী মাত্রায় তেতে উঠেছে। মাথার উপরে থাকা হেলানো ছাতার নিচে বসেও ঘামছে মর্জিনা। ফিসফিনে আাঁচল দিয়ে কপালটা মুছে পেটের কাছে লেপ্টে থাকা বাচ্চাটাকে টেনে বুকের কাছে নিয়ে এলো। বুকের কাছে কাপড়টা ক্ষানীক উঁচু করে বাচ্চাটার মুখ ঠেলে দিল ভেতরে। ওর শুষ্ক ঠোঁটজোড়া খোঁজে নিল মায়ের স্তনবৃন্ত।
বাচ্চাটাকে পেটে রেখেই তার স্বামী নামক পাষন্ডটা ভেগে গেছে। বস্তির ঘরটায় যখন একা থাকা দায় হয়ে উঠে ছিল, তখনি পাশে এসে দাঁড়িয়েছে পাশের ঘরের বয়সী রহিমা খালা। নিজে বাসাবাড়িতে কাজ করে পোয়াতি মেয়েটাকে নিজের সন্তানের মত আগলে রেখেছে। আজ সেই খালাই যখন বয়সের ভারে শয্যাশায়ী, তখন স্বাভাবিক ভাবেই একজন মেয়ের মতই তার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে তাকে। সে কারণেই সদ্যজাত ছেলেটাকে সাথে নিয়েই কাজে বেরিয়ে পড়েছে সে।
বস্তির একজনকে ধরে এই কাজটা নিয়েছে। তার মত আরো অনেকেই এখানে ইট ভাঙ্গে। তবে সন্তান সমেত নতুন মা কেবল সে একাই। মাত্র কদিনেই কাজটা বেশ রপ্ত করে ফেলেছে। সবচেয়ে অবাক ব্যপার কোনরকম আংগুল থেতলানো ছাড়াই কাজটা বেশ সুচারুভাবেই করে যাচ্ছে। মাত্র মাস দুয়েকের বাচ্চাটাকে কোলের কাছে পেটের সাথে লেপটে নিয়ে বসে কাজ করতে তার তেমন কোন অসুবিধেই হচ্ছে না। তবে সকালের পাতলা সূর্যটা দিনের সাথে সাথে যতই ঘন হতে থাকে ততই তারও বাচ্চাটাকে বারবার সরিয়ে রোদের ছোঁয়া বাঁচিয়ে রাখতে হয়। এতটুকুন ছেলে তাকে বাসায় রেখে আসবে সেও সম্ভব নয়। বুকের দুধ খেয়েই বেঁচে আছে সে। এদিকে কাজ না করলে তার আর রহিমা খালার মুখেও খাবার জুটবে না।
স্তনের ডগা থেকে ছেলেটা মুখ সরিয়ে নিতেই ডান হাতটা ভেতরে ঠেলে কাপর টেনে বুক ঢাকলো মর্জিনা। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো ছেলেটার উদোম পা জোড়া বেরিয়ে আছে। টেনেটুনে আাঁচলটা নামিয়ে তার পা দুটি ঢাকতেই হেডম্যানের কর্কশ কন্ঠটা কানে বাড়ি মারলো।
- কিরে তুই পোলা সামলাবি না কাম করবি ? ভাংগা সুড়কির স্তুপের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে সে। এক হাত কপালের কাছে রেখে রোদটাকে আড়ালের চেষ্টা করে যাচ্ছে। চিবানো পানের পিকটা মাটিতে ফেলে যোগ করলো, ওরে তুই বাসাত রাইখ্যা আয়। নাইলে কাম করতে পারবি না।
- কি করুম ভাইজান। কঁকিয়ে উঠলো মর্জিনা। কাছলি বাচ্ছা। বুকের দুধ না পাইলে বাাঁচবো কেমতে ? আর কাম না করলে আমাগো না খাইয়া থাকতে হইবো।
- আচ্ছা হইছে। বুঝছি। জ্বলদি কাম চালা। নতুন ইট আইতাছে। এডি শেষ কইরা আবার নতুন ইট ধরতে হইবো। বলেই গটগট পায়ে অন্যদিকে চলে গেল লোকটা। তার অপসৃয়মান শরীরের দিকে তাকিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো মর্জিনা।
পরদিন সকালে কাজে যেয়েই শুনলো হেডম্যান খুঁজছে তাকে। এক অজানা আশংকায় বুকটা দুলে উঠলো তার। কাজটা বুঝি আর রইলো না। দুরু দুরু পায়ে এগিয়ে গেল অফিসের দিকে। বাঁশের বেড়ার ছোট্ট একটা ঘর। উপরে একচালা টিন। সামনের দিকে ফুট তিনেক বাড়ানো। ওটার ছায়ায় দাঁড়িয়ে ভিরু ভিরু কন্ঠে জানতে চাইলো মর্জিনা, আমারে ডাকছিলেন ভাইজান ?
-হুম। চিন্তা কইরা দেখলাম। তোরে এই রকম পোলা নিয়া আর কাম করন দেওন যাইবো না।
কথাটা শুনেই মুষরে গেল মর্জিনা। বুকের কাছে ছেলেটাকে আরো শক্ত করে চেপে ধরলো।
-তয় তুই চাইলে অন্য ব্যবস্থা আছে। ভ্রু উঁচিয়ে কথাটা বলল হেডম্যান। খালি তুই যদি আমার কথা শুনছ। কথাটা বলেই এক চোখ ছোট করে একটা ইঙ্গিতপূর্ণ ভঙ্গি করলো।
বুঝলো মর্জিনা। লোকটা তার অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে চাইছে। মনটা বিদ্রোহ করতে চাইলো। পরক্ষণেই কোলের সন্তান আর অসুস্থ রহিমা খালার কথা মনে আসতেই চুপসে গেল। দৃষ্টি আনত করে করে বলে উঠলো, আমারে কি করতে হইবো কন?
মর্জিনা ভেতরে যেয়ে দেখতে পেল ওখানে কেবল একটা চকি পাতা। তার উপর ফুল তোলা চাদর বিছানো। মাথার দিকে একটা বালিশ রাখা। নিজের সংসার জীবনের কথা মনে এলো তার। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিড়ে। ঘুরে চকির মাথায় বসলো সে। ত্রস্ত চোখে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকলো। ছেলেটাকে আরো শক্ত করে চেপে ধরলো বুকের সাথে।
তুই বয় এখানে। আমি অহনি আইতাছি। হেঁটে চলে গেল অফিস রুমের দরজার দিকে। চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আলতো করে মুখটা বের করে ইতি-উতি তাকালো লোকটা। সবাই যার যার কাজে ব্যাস্ত। নিশ্চিত মন নিয়ে আবারো ভেতরে টেনে নিলো মাথাটা। আস্তে করে দরজাটা টেনে দিল সে।
দরজা বন্ধ করার শব্দটা মর্জিনাও শুনতে পেলে। ছেলেটাকে বুকের কাছ থেকে নামিয়ে বিছানার এক পাশে শুইয়ে দিল। তারপর নিজেও শুইয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করে নিল। পা দুটো ঝুলে আছে তার বিছানা থেকে। মাটি ছুঁয়ে থাকলেও মনে হচ্ছে পায়ের নিচে মাটি নেই তার।
লোকটা এগিয়ে এসে দাঁড়ালো একদম মর্জিনার পায়ের কাছে। আর একটু এগোলেই ঠুকাঠুকি লেগে যাবে দু’জনের হাঁটুতে। কম্পিত হৃদয়ে মর্জিনা ঘটনার আদলে ঘটতে যাওয়া নিশ্চিত দুর্ঘটনাটাকে মেনে নেবার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হলো। আর তখনি কথা বলে উঠলো লোকটা।
- এহন থাইক্যা তোমার পোলাডা পত্যেক দিন এহানে হুইয়া থাকবো। ওর কান্দন হুনলেই তুমি আইস্যা বুহের দুধ খাওয়াইয়া যাইবা। তারপর ওরে রাইখ্যা আবার কাম করবা। বিহালে কাম শেষ অইলে ওরে নিয়া যাইবা।
কথাগুলো কানে যেতেই লাফিয়ে উঠে বসলো মর্জিনা। তার চোখে পানি চলে এলো। নিজের কানকেও সে বিশ্বাস করতে পারছে না।
লোকটা তখনো বলে যাচ্ছে, তুমি যতক্ষণ এহানে থাকবা আমি বাইরের দরজা বন্ধ কইরা অফিসরুমে বইসা তোমারে পাহারা দিমু। তোমারে কেউ ডিস্টার্ব করবো না।
-ওর বয়সী আমারো একটা পোলা আছে গেরামে। এই ঢাকা শহরে কাম করনের লাইগ্যা আইসা এমনি ফাঁসা ফাঁসছি যে, জন্ম নেওনের পর এহনো ওর মুখ দেখবার পারি নাই। এবার হেডম্যান নিজেই কঁকিয়ে উঠলো। তারপর ঘুরে পরদা সরিয়ে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়ে আবারো ঘাড় ফেরালো, তোষকের তলে একটা ওয়ালক্লথ রাখছি। আমার পোলার লাইগা কিনছিলাম। তোমার পোলাডারে ওইডা বিছাইয়া হুয়াইও। আমি আবার ভিজা বিছনায় হুইবার পারি না। বলেই হেসে দিল। তারপর যোগ করলো, তুমি কাম সাইরা আসো। আমি বাইরে আছি ।
পাষন্ড স্বামীকে হারিয়ে হেরেই গিয়েছিল মর্জিনা। তারপরেও ঘুরে দাঁড়াবার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছিল। আজ তার মনে হচ্ছে সে সত্যিই জিতে গেছে। এই জয় তার নারীত্বের। এই জয় তার মাতৃত্বের।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Jamal Uddin Ahmed
সম্ভবত ফেসবুকে আপনাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। আমার অনিয়ম এবং অসংলগ্নতা ক্ষমা করবেন, প্লিজ।
মোঃ মোখলেছুর রহমান
মোঃ মোখলেছুর রহমান এই সংখ্যার প্রথম পড়া এটি, মোঃ মাইদুল সরকারের সাথে এক মত "মাঝখানে গল্পের মোড় 180 ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরে গেছে যা গল্পটিকে সার্থক করেছে"।
ভাই , আমি এই প্রথমবার বাংলাদেশ হয়তো যেতে পারি দু-তিনদিনের জন্য। আমার ইচ্ছে আছে যদি সময় পাই
তবে " গল্প - কবিতার " অফিসে দেখা করবার। অনুগ্রহ করে জানাবেন ঢাকা শহর থেকে কি ভাবে যাবো
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
মাতৃত্বের জয়
২৪ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৭০ টি
সমন্বিত স্কোর
৫.০১
বিচারক স্কোরঃ ২.৬১ / ৭.০পাঠক স্কোরঃ ২.৪ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।